"বাংলাদেশের দ্রুত বৃদ্ধি আজ শুধু দেশীয় পরিমণ্ডলে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্ময়, আগ্রহ ও প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। একসময় যাকে উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ, দারিদ্র্য, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হতো, সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়, গতিশীল ও দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিল্পায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বিস্তারে বাংলাদেশ এমন এক অবস্থান তৈরি করেছে, যা অনেক বড় দেশের কাছেও অনুকরণীয়।
বাংলাদেশের দ্রুত বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয়, শ্রমঘন কর্মসংস্থান এবং নারীর আর্থিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছে। লাখো শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম, উদ্যোক্তাদের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ, এবং সরকারের নীতি-সহায়ক পরিবেশ গার্মেন্টস শিল্পকে একটি বিশ্বমানের খাতে পরিণত করেছে। এর ফলে জাতীয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, যা বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রগতির মূল ভিত্তি।
এ ছাড়া দেশের রেমিট্যান্স খাত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রেখেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায়নি, বরং গ্রাম-শহর উভয় অঞ্চলে পরিবারের জীবনমান উন্নয়ন, স্থায়ী বিনিয়োগ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এবং ভোক্তা ব্যয়কে শক্তিশালী করতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
বাংলাদেশের দ্রুত বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, দ্বৈত রেললাইন, মহাসড়ক বিস্তৃতি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি—এসব প্রকল্পের ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক হচ্ছে, উৎপাদন খরচ কমছে, এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়ছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করে, গ্রামীণ অর্থনীতিকে শহরের সঙ্গে যুক্ত করে, এবং শিল্পায়নকে গতিশীল করে তোলে। এসব সুবিশাল প্রকল্প শুধু বর্তমান অর্থনীতিকে নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে।
তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবও বাংলাদেশের দ্রুত বৃদ্ধির একটি মূল উপাদান। ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগ, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম—সব মিলিয়ে আজ প্রযুক্তি বাংলাদেশের নতুন শক্তি। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারের যে বিস্তৃতি ঘটেছে, তা তরুণদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। আইটি সেবার মাধ্যমে বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি-চালিত অর্থনীতির গোড়াপত্তন বাংলাদেশের অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
সভ্যতার অগ্রগতিতে মানবসম্পদ উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এবং এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো—এসব সূচক বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নে শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া বাংলাদেশের অগ্রগতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি-সহায়ক পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যার ফলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ধারাবাহিক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। Vision 2041, Delta Plan 2100—এসব পরিকল্পনা ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীল, টেকসই ও আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের নির্দেশনা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের দ্রুত বৃদ্ধির গল্পটি তাই শুধু অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নয়—এটি সাহস, পরিশ্রম, বাস্তবমুখী পরিকল্পনা, উদ্ভাবন এবং আত্মবিশ্বাসের সমন্বয়ে গঠিত এক অনন্য যাত্রা। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতির বড় মাইলফলক, এবং যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে, তবে আগামীর বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধ, আধুনিক ও স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
বাংলাদেশের দ্রুত বৃদ্ধি এখন আর স্বপ্ন নয়—এটি চলমান বাস্তবতা, এবং ভবিষ্যৎ এই গতি আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।"